
জন্ম নিবন্ধন হলো নাগরিকদের প্রথম রাস্ট্রীয় পরিচয়পত্র বা ডকুমেন্ট। এই ডকুমেন্ট এর বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে অনাকাঙ্খিত বিভিন্ন কারণে জন্ম নিবন্ধন নষ্ট হয়ে যেতে পারে, অথবা হারিয়ে যেতে পারে। এক্ষেত্রে অনেকেই বুঝিনা জন্ম নিবন্ধন হারিয়ে গেলে করণীয় কি বা পাওয়ার উপায় কি।
আমাদের জন্ম নিবন্ধন অনেক সময় পুড়ে যায়, নষ্ট হয়ে যায়, চুরি হয়ে যায় অথবা হারিয়ে যায়। এটা একটি স্বাভাবিক ব্যাপার এবং এই পরিস্থিতিতে যে কেউ পড়তে পারে।
অনেকেই বলেন ভাই আমার জন্ম নিবন্ধন হারিয়ে গেছে, এখন আমি কিভাবে কি করব? এমনটা বলে বলে হতাশা প্রকাশ করেন। আসলে এতে হতাশ হওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই।
আপনার নিবন্ধন হারিয়ে গেলে পাওয়ার উপায় কি তাই আজ আমি আপনাকে বলে দেবো। আপনি যদি বাংলাদেশের নাগরিক হয়ে থাকেন, তবে আপনার জন্ম নিবন্ধন হারিয়ে গেলে কিভাবে পাওয়া যাবে এই বিষয়েই আজকের আলোচনা।
চলুন বিস্তারিত জেনে নিই জন্ম নিবন্ধন হারিয়ে গেলে কি করতে হয় এবং এটি নতুন করে পাওয়ার উপায় সম্পর্কে।
জন্ম নিবন্ধন হারিয়ে গেলে করণীয় কি?
জন্ম নিবন্ধন হারিয়ে যাওয়ার আগেই মূলত এর অরিজিনাল কপিটি থেকে আরো কয়েকটি সাব কপি প্রিন্ট করে রাখা ভালো।
তাছাড়া, মোবাইলের মাধ্যমে জন্ম নিবন্ধনের ছবি উঠিতে রাখাটাও সচেতনতার মধ্যে পড়ে।
আপনার জন্ম নিবন্ধনটি যদি হারিয়ে যায়, তবে প্রাথমিক করণীয় হলো অনলাইনের মাধ্যমে জন্ম নিবন্ধন সনদ পুনঃমুদ্রন বা প্রতিলিপির জন্য আবেদন করা।
অথবা, সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা, সিটি কর্পোরেশন অথবা নির্বাচন অফিসে স্বশরীরে যোগাযোগ করা।
- আরো পড়ুনঃ সার্টিফিকেট হারিয়ে গেলে করণীয়।
অনলাইনে জন্ম নিবন্ধন পুনঃমুদ্রন করার জন্যে আপনার জন্ম নিবন্ধনে দেওয়া জন্ম তারিখ এবং জন্ম নিবন্ধনের নম্বরটি প্রয়োজন হবে। তাহলে আপনি অনলাইনের মাধ্যমে জন্ম নিবন্ধন এর প্রতিলিপির জন্য আবেদন করতে পারবেন।
আর যদি আপনার কাছে জন্ম নিবন্ধনের নম্বর এবং জন্ম তারিখটি সংরক্ষণ না থাকে তবে আপনি প্রতিলিপির জন্য অনলাইনে জন্ম নিবন্ধনের আবেদন করতে পারবেন না।
হারানো জন্ম নিবন্ধন তথ্য জানা না থাকলে করণীয়
আপনার জন্ম নিবন্ধন সনদটি যদি হারিয়ে যায় এবং এর কোনো তথ্যই যদি আপনার সংগ্রহে না থাকে, তবে আপনার পার্সোনাল কিছু তথ্য দিয়ে একটি ডকুমেন্ট তৈরি করবেন। যেমনঃ নিবন্ধনকারীর নাম, জন্ম তারিখ, মাতা-পিতার নাম, গ্রামের নাম ইত্যাদি তথ্য দিয়ে।
তারপর এই ডকুমেন্টটি নিয়ে সরাসরি আপনার সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা বা সিটি কর্পোরেশনের অফিসে যেতে হবে। অতঃপর কাঙ্খিত সেই অফিসের কম্পিউটার অপারেটরকে জন্ম নিবন্ধন হারিয়ে যাওয়ার বিষয়টি বলে ডকুমেন্টটি প্রদান করতে হবে।
আপনার জন্ম নিবন্ধনটি যদি ডিজিটাল জন্ম নিবন্ধন হয়ে থাকে, তবে তারাই আপনার দেওয়া ডকুমেন্টের ভিত্তিতে অনলাইন ডেটাবেজ থেকে ৫ মিনিটের ভেতরেই আপনার জন্ম নিবন্ধনের সমস্ত তথ্য বের করে দেবে। এক্ষেত্রে চার্জ প্রযোজ্য হতে পারে।
আবার আপনার জন্ম নিবন্ধন যদি ডিজিটাল না হয়, তবে এর তথ্য খুঁজে বের করা অনেক কঠিন হয়ে যাবে। এক্ষেত্রে নতুন করে জন্ম নিবন্ধন করতে হতে পারে।
কারণ, আপনার হারানো জন্ম নিবন্ধনের কোনো তথ্যই আপনার সংগ্রহে নেই। এই বিষয়ে সর্বোত্তম পরামর্শ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মাধ্যমেই পাবেন।
জন্ম নিবন্ধন সনদ পুনঃ মুদ্রন করার নিয়ম
আপনার জন্ম নিবন্ধন সনদটি যদি কোনো ভাবে নষ্ট হয়ে যায় অথবা হারিয়ে যায়, তবে আপনার জন্ম নিবন্ধনের নম্বর এবং জন্ম তারিখ দিয়ে জন্ম নিবন্ধন সনদ পুনঃমুদ্রন করতে পারবেন।
পুনঃমুদ্রণ বা প্রতিলিপি এর মানে হচ্ছে জন্ম নিবন্ধনটিতে পুনরুদ্ধার করা। এটি করার জন্য বর্তমানে সবচেয়ে সহজ পদ্ধতি হলো বাংলাদেশ সরকারের Birth certificate এর অফিসিয়াল ওয়েবসাইটের শরণাপন্ন হওয়া।
হারিয়ে যাওয়া জন্ম নিবন্ধন সনদ এর প্রতিলিপির জন্য অনলাইনে কিভাবে আবেদন করবেন, তা স্টেপ বাই স্টেপ দেখিয়ে দেওয়া হলো।
স্টেপ -০১
প্রথমেই Google এ গিয়ে সার্চ করুন “birth certificate reprint” লিখে।
অথবা সরাসরি এই ওয়েবসাইটে প্রবেশ করুনঃ https://bdris.gov.bd/
ওয়েবসাইটটিতে প্রবেশ করার পর উপরের ছবির মতো একটি ওয়েবপেজ ওপেন হবে।
এই ওয়েবপেজের হেডিংয়ের মেনুবার থেকে ”জন্ম নিবন্ধন” মেনুতে ক্লিক করুন। তারপর ”জন্ম নিবন্ধন সনদ পুনঃ মুদ্রন” বাটনে ক্লিক করুন।
উপরের ছবিতে তীর চিহ্ন দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া হয়েছে। মনোযোগ সহকারে ফলো করুন।
স্টেপ -০২
দ্বিতীয় স্টেপে আপনার সামনে উপরের মতো একটি ওয়েবপেজ ওপেন হবে।
এখানে আপনা জন্ম নিবন্ধন সনদ নম্বর এবং জন্ম তারিখ দিয়ে খালিঘর পূরণ করতে হবে।
খালিঘর পূরণ করে ”অনুসন্ধান” বাটনে ক্লিক করুন।
আপনার দেওয়া তথ্য যদি সঠিক হয়, তবে নিচে আপনার আইডি নং, জন্ম তারিখ, নাম, মা-বাবার নাম ইত্যাদি দেখতে পাবেন। তারপর “নির্বাচন করুন” বাটনে ক্লিক করতে হবে।
উল্লেখ্য, এখানে সঠিক তথ্য দেওয়ার পরও যদি কোনো কারণে রেজাল্ট না দেখতে পান, তবে হতাশ হওয়ার প্রয়োজন নেই। আপনাকে সরাসরি সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা বা সিটি কর্পোরেশনের অফিসে যোগাযোগ করতে হবে।
স্টেপ -০৩
তৃতীয় স্টেপে আসার পর উপরের উপরের ছবির মতো একটি ফরমপেজ ওপেন হবে। ফরমের খালিঘরগুলো উপযুক্ত তথ্য দিয়ে পূরণ করতে হবে।
এখানে আপনার দেশ, বিভাগ, জেলা, উপজেলা / ক্যান্টনমেন্ট, সিটি কর্পোরেশন এবং পৌরসভা / ইউনিয়ন সিলেক্ট করতে হবে।
পৌরসভা / ইউনিয়ন সিলেক্ট করার পর অফিসের ঠিকানা অটোমেটিক সিলেক্ট হয়ে যাবে।
তারপর আবেদনকারীর তথ্য দিতে হবে।
আপনি যদি নিজেই জন্ম নিবন্ধন সনদ পুনঃ মুদ্রন করার আবেদনকারী হয়ে থাকেন, তবে “আবেদনাধীন ব্যক্তির সহিত সম্পর্ক” থেকে “নিজ” সিলেক্ট করবেন।
আর যদি আবেদনকারী আপনার পিতা হয়, তবে ”পিতা” সিলেক্ট করবেন।
আবেদনকারী যেই হোকনা কেন, তার সাথে আপনার সম্পর্ক কি তাই মূলত এখানে দিতে হবে।
তারপর আবেদনকারীর নাম, ঠিকানা এবং মোবাইল নম্বর দিতে হবে। পাশের ঘরে ইমেইল দিতেও পারেন, আবার না দিলেও সমস্যা সেই।
সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে ”সাবমিট” বাটনে ক্লিক করুন।
উল্লেখ্য, পূর্বের পেজে যাওয়ার প্রয়োজন হলে ”পূর্ববর্তী” বাটনে ক্লিক করতে হবে।
স্টেপ -০৪
সাবমিটে ক্লিক করার পর আপনার সামনে উপরের ছবিব মতো একটি কনফার্ম পেজ আসবে।
এখানে আপনার আবেদন পত্রের নম্বর উল্লেখ করা থাকবে। তাছাড়া, আরো কিছু বিষয় বলা আছে। পড়ে নেবেন অবশ্যই।
আপনার করা আবেদনপত্রটি ডাউনলোড করার জন্যে ”আবেদনপত্র প্রিন্ট” বাটনে ক্লিক করুন।
স্টেপ -০৫

পঞ্চম স্টেপে আসার পর আপনার জন্ম নিবন্ধন সনদটি দেখাবে। এখান থেকে আপনি জন্ম নিবন্ধন সনদটি pdf আকারে ডাউনলোড করে নিন।
ডাউনলোড করার পর অবশ্যই জন্ম নিবন্ধনটিকে প্রিন্ট করে নেবেন। প্রিন্ট করে আপনার সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা, সিটি কর্পোরেশন অথবা নির্বাচন অফিসে প্রিন্ট কপিটি জমা দেবেন।
তারপর কর্তৃপক্ষ আপনার জন্ম নিবন্ধন সনদ ডাউনলোড অনলাইন কপিটিতে প্রয়োজনীয় সীল, স্বাক্ষর দিয়ে দেবে। অথবা তারা এই কপিটি জমা নিয়ে নেবে এবং জন্ম নিবন্ধনটির অরিজিনাল প্রতিলিপি তৈরির জন্য একটি নির্দিষ্ট সময় বলে দেবে।
যদি আপনার জন্ম নিবন্ধন সনদের ডাউনলোড কপিটি জমা নিয়ে নেয়, তবে সাধারণত ১৫ দিনের মধ্যেই অরিজিনাল কপিটি দিয়ে দেবে।এতে হয়ত ফি প্রযোজ্য হবে।
জন্ম নিবন্ধন সনদ পুনঃ মুদ্রন এর ফি ৫০ টাকা থেকে ১০০ টাকার মধ্যেই হবে। এটি আপনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে জেনে নিতে পারবেন।
জন্ম নিবন্ধন সনদ ডাউনলোড অনলাইন কপি
আপনার হারিয়ে যাওয়া জন্ম নিবন্ধনটি যদি ডিজিটাল জন্ম নিবন্ধনের অন্তর্ভূক্ত হয়ে থাকে, তবে আপনি আপনার ডিজিটাল জন্ম নিবন্ধন সনদ অনলাইন থেকে ডাউনলোড করে নিতে পারবেন।
জন্ম নিবন্ধন ডিজিটাল হলে অনেক সুবিধা পাওয়া যায়। বিশেষ করে কখনও যদি আপনার জন্ম নিবন্ধন হারিয়ে যায়, তবে সহজেই অনলাইন থেকে সংগ্রহ করে নিতে পারবেন।
আপনার জন্ম নিবন্ধনটি অনলাইনে যাচাই ও ডাউনলোড করার জন্যে এই আর্টিকেলটি অবশ্যই পড়ুনঃ অনলাইনে জন্ম নিবন্ধন যাচাই ও ডাউনলোড।
হাতে লেখা জন্ম নিবন্ধন গুলো মূলত এনালগ জন্ম নিবন্ধন। ২০১০ সাল থেকেই সকল জন্ম নিবন্ধন ডিজিটাল করার কার্যক্রম শুরু হয়েছিল।
বর্তমানে নতুন করে যত জন্ম নিবন্ধন তৈরি হচ্ছে, সবই ডিজিটাল জন্ম নিবন্ধনের অন্তর্ভূক্ত।
আপনার জন্ম নিবন্ধনটি যদি এখনো এনালগ জন্ম নিবন্ধন হিসেবেই থাকে, তবে এখনই ডিজিটাল করে নিন। জন্ম নিবন্ধনকে ডিজিটাল করার নিয়ম মূলত প্রতিলিপির আবেদনের মতই।
বিষয়টি আরো সহজভাবে বুঝতে অবশ্যই এই আর্টিকেলটি পড়ুনঃ পুরাতন জন্ম নিবন্ধন ডিজিটাল করার নিয়ম।
গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথাঃ
প্রিয় পাঠক, জন্ম নিবন্ধন আমাদের দৈনন্দির জীবনে বিভিন্ন কাজে প্রয়োজন হয়। বিশেষ করে শিক্ষা ও চাকরি ইত্যাদির ক্ষেত্রে। এজন্যই মূলত জন্ম নিবন্ধন সনদ সাথে রাখতে হয়। অনেক সময় এটি অনাকাঙ্খিত ভাবে হারিয়ে যায় অথবা নষ্ট হয়ে যায়।
তবে আপনার কাছে যদি নিবন্ধনটির নম্বর এবং জন্ম তারিখ থাকে তবে আপনি অনলাইনে জন্ম নিবন্ধন সনদ পুনঃ মুদ্রন করার জন্য আবেদন করতে পারবেন। পাশাপাশি ডাউনলোড করারও অপশন রয়েছে।
তবে কারো জন্ম নিবন্ধন হারিয়ে যাওয়ার পর যদি নিবন্ধন নম্বর এবং জন্ম তারিখ মনে না থাকে, তবে এই জন্ম নিবন্ধন পুনরুদ্ধার করা অনেক কষ্টকর হয়ে যায়।
তাই আমাদের উচিত জন্ম নিবন্ধন হারিয়ে যাওয়ার আগেই এর অরিজিনাল কপিটি থেকে আরো বেশ কিছু সাব কপি প্রিন্ট করে রাখা। আর জন্ম নিবন্ধন যদি এনালগ হয় তবে অবশ্যই ডিজিটাল করে নেওয়া।
তাহলে জন্ম নিবন্ধন হারিয়ে গেলেও খুব বেশী ভয় বা হতাশা থাকে না। এজন্য জন্ম নিবন্ধন হারিয়ে গেলে করণীয় কি এটা ভাবার আগে জন্ম নিবন্ধন থাকাকালীল করণীয়গুলো ফলো করা উচিত।
যাইহোক, জন্ম নিবন্ধন হারিয়ে গেলে পাওয়ার উপায় কি আশাকরি তা আপনারা বুঝতে পেরেছেন। এই বিষয়ে যদি আপনাদের কারো কোনো প্রশ্ন থাকে তবে অবশ্যই কমেন্ট করবেন। সবাইকে ধন্যবাদ