
ভ্রমণপ্রেমী বা প্রবাসী ব্যক্তিদের জন্য পাসপোর্ট খুবই গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্ট। পাসপোর্ট ছাড়া এক দেশ থেকে অন্য দেশে ভ্রমণ করা যায় না।বাংলাদেশে ১৯৭৩ সালে পাসপোর্টের যাত্রা শুরু এবং ২০২০ সালে ই-পাসপোর্ট নামে নতুন সেবা চালু করেছে সরকার। ই পাসপোর্ট কি এবং পাসপোর্ট কত প্রকার তা জানার কৌতুহল থাকলে এই আর্টিকেলটি আপনার জন্যই।
আন্তর্জাতিক ভাবে সারা বিশ্বেই পাটপোর্টের প্রচলন রয়েছে। পাসপোর্টের সূচনা হয় আনুমানিক ৪৫০ খ্রিষ্টাব্দে। যা মধ্যযুগীয় ইসলামিক খেলাফতের সময়।
তখন শুল্ক প্রদানের রশিদকে পাসপোর্ট হিসেবে ব্যবহার করা হতো। মুসলিমদের মধ্যে যারা যাকাত ও জিজিয়া কর প্রদান করতো, শুধুমাত্র তারা খেলাফতের শাসনাধীন বিভিন্ন অঞ্চলে ভ্রমণ করতে পারতো। ভ্রমণকারীদের শুল্ক প্রদানের রশিদ পাসপোর্টের অনুরূপ ছিল।
পাসপোর্ট কি?
পাসপোর্ট (passport) হলো এক ধরণের ভ্রমণ নথি, যা সাধারণত একটি দেশের গভর্নমেন্ট কর্তৃক জারি করা হয়।
এই নথির মাধ্যমে মূলত আন্তর্জাতিক ভাবে এক দেশ থেকে অন্য দেশে ভ্রমণের সময় বাহকের জাতীয়তা ও পরিচয় প্রত্যায়িত করে।
পাসপোর্টে সাধারণত বাহকের নাম, জন্ম তারিখ, ঠিকানা, ছবি, সাক্ষর, ফিংগার প্রিন্ট, চোখের আইরিশ ইত্যাদি তথ্য দেওয়া থাকে। যা দিয়ে বাহককে চিহ্নিত করা হয়।
পাসপোর্টের একটি নির্দিষ্ট মেয়াদ থাকে, যা গভর্নমেন্ট নির্ধারণ করে দেয়। মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে কিছু প্রসেস ফলো করে পাসপোর্ট নবায়ন করতে হয়।
বর্তমানে দুই ধরণের পাসপোর্ট এর কথা শুনতে পাওয়া যায়। যেমন – এম আর পি পাসপোর্ট ও ই-পাসপোর্ট।
ই পাসপোর্ট কি?
E-passport কে ডিজিটাল পাসপোর্ট বা ইলেক্ট্রনিক পাসপোর্ট বলা হয়। অর্থাৎ, পাসপোর্টের আধুনিক ভার্সনকে ই-পাসপোর্ট নামে ডাকা হয়।
কিন্তু সাধারণ ভাবে পাসপোর্ট ও ই-পাসপোর্ট এর মধ্যে তেমন কোনো ভিন্নতা নেই। বর্তমানে এমআরপি বা যন্ত্রে পাঠযোগ্য পাসপোর্টের মতো ই-পাসপোর্টের বইও একই রকম থাকবে।
তবে ই-পাসপোর্টে প্রযুক্তিগত কিছু ফিচার যুক্ত করা হয়েছে। যেমন- পাসপোর্টের বইয়ের প্রথমে যে তথ্য সংবলিত দুইটি পাতা থাকে, ই-পাসপোর্টে তা নেই।
সেখানে বরং পালিমানের তৈরি একটি কার্ড ও অ্যান্টেনা যুক্ত করা হয়েছে। সেই কার্ডের ভেতরে চিপ থাকবে, যেখানে পাসপোর্ট ব্যবহারকারীর সব তথ্য সংরক্ষিত থাকবে।
ন্যাশানাল ভোটার আইডি কার্ডের যে স্মার্টকার্ডটি দেওয়া হয়, সেটিতে যেমন চিপ থাকে, পাসপোর্টেও তাই করা হয়েছে।
সেই চিপে একটি ইলেক্ট্রনিক ডেটাবেজ যুক্ত রয়েছে, সেই ডেটাবেজে পাসপোর্ট বাহকের তিন ধরণের ছবি, দুই হাতের আঙ্গুলের ছাপ ও চোখের আইরিশ থাকবে।
এর ফলে পাসপোর্টধারী যে কোনো দেশেই ভ্রমণ করতে যাক, সে দেশের কর্তৃপক্ষ খুব সহজেই পাসপোর্টের মাধ্যমে বাহক সম্পর্কে সব তথ্য জানতে পারবে।
সারাবিশ্বে এ পাসপোর্ট চালুর ক্ষেত্রে ১১৯তম দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থান। অন্যদিকে, দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশই প্রথম ই-পাসপোর্ট চালু করেছে।
এম আর পি পাসপোর্ট কি?
মেশিন রিডেবল এম আর পি (MRP) পাসপোর্ট সাধারণ ভাবে পুরানো জাতীয় পরিচয় পত্রের সাথে তুলনা করতে পারেন।
আগে যেই ধরণের জাতীয় পরিচয় দেওয়ার হতো, তাতে শুধুমাত্র নিজের নাম, মাতা-পিতার নাম, জন্ম তারিখ, এক আঙ্গুলের ছাপ বা সাক্ষর ও ঠিকানা ইত্যাদি উল্লেখ থাকতো।
কিন্তু জাতীয় পরিচয় পত্রের স্মার্টকার্ড গুলোতে কার্ডধারীর প্রায় সমস্ত তথ্য চিপের ডেটাবেজে উল্লেখ থাকে।
যেমন- কার্ডধারীর রঙিন ছবি, দুই হাতের দশ আঙ্গুলের ছাপ ও দু’চোখের আইরিশ উক্ত কার্ড চিপের ডেটাবেজ সংরক্ষিত থাকে।
এম আর পি পাসপোর্ট ও ই পাসপোর্টের পার্থক্য এখানেই।
পাসপোর্ট কত প্রকার?
বাংলাদেশ গভর্নমেন্ট তিন ধরণের পাসপোর্ট ইস্যু করে। যেমন –
- সাধারণ পাসপোর্ট (সবুজ পাসপোর্ট)
- দাপ্তরিক পাসপোর্ট (নীল পাসপোর্ট)
- কূটনৈতিক পাসপোর্ট (লাল পাসপোর্ট)
সাধারণ পাসপোর্ট কি /সবুজ পাসপোর্ট কি?
সবুজ পাসপোর্টকে বলা হয় সাধারণ পাসপোর্ট বা অর্ডিনারি পাসপোর্ট। এই পাসপোর্টটি দেশের সকল সাধারণ নাগরিকের জন্য ইস্যু করা হয়।
যারা জন্মসূত্রে এবং বৈবাহিক উভয় সূত্রে বাংলাদেশের নাগরিক, তাদের জন্যই এই সবুজ পাসপোর্ট।
এই পাসপোর্টটি দিয়ে বিদেশে গমনের জন্য অবশ্যই সংশ্লিষ্ট দেশের ভিসা থাকতে হবে।
দাপ্তরিক পাসপোর্ট কি / নীল পাসপোর্ট কি?
নীল রঙের পাসপোর্টকে বলা হয় দাপ্তরিক পাসপোর্ট / সরকারি পাসপোর্ট / অফিসিয়াল পাসপোর্ট।
গভর্নমেন্টের কাজে কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারী যদি বিদেশে ভ্রমণ করে তবে এই নীল পাসপোর্টটি ব্যবহার করা হয়।
এই পাসপোর্টটি সাধারণ পাসপোর্ট থেকে অনেক শক্তিশালী। এটি দিয়ে বিনাভিসায় সারাবিশ্বের অন্তত ২৭টি দেশে পাসপোর্টধারী ভ্রমণ করতে পারবে।
এ পাসপোর্টটি করতে অবশ্যই সংশ্লিষ্ট সরকারি অফিসের অনুমোদন (জিও) প্রয়োজন হবে।
কূটনৈতিক পাসপোর্ট কি / লাল পাসপোর্ট কি?
লাল রঙের পাসপোর্টকে বলা হয় কূটনৈতিক পাসপোর্ট বা ডিপ্লোম্যাটিক পাসপোর্ট।
এই পাসপোর্ট শুধুমাত্র দেশের উচ্চ কর্মকর্তাগণই পেয়ে থাকেন। যেমন- রাষ্ট্রপ্রধান, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিসভার সদস্য, সংসদ সদস্য এবং তাদের স্বামী/ স্ত্রী।
তাছাড়া, উচ্চ আদালতের বিচারপতি, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, পাবলিক সার্ভিস কমিশনের প্রধান এবং মন্ত্রণালয়ের সচিব এবং বিদেশে বাংলাদেশি মিশনের কর্মকর্তাগণ এই লাল পাসপোর্ট পেয়ে থাকেন।
লাল পাসপোর্টধারী বিনাভিসায় যে কোনো দেশে ভ্রমণ করতে পারবেন। কেননা, তারা সংশ্লিষ্ট দেশে অবতরণের পর সরকরি ভাবে অন-অ্যারাইভাল ভিসা পান।
পাসপোর্ট দিয়ে কি কি করা যায়?
অনেক কাজ আছে, যে কাজ গুলো করতে পাসপোর্ট রিকোয়ারমেন্ট থাকে। আবার পাসপোর্ট থাকলে অনেক কাজ সহজে করা যায়।
আপনার যদি ন্যাশানাল আইডি কার্ড উপস্থিত না থাকে, এই পরিস্থিতিতে আপনি পাসপোর্ট দিয়ে প্রায় সব ধরণের কাজই করতে পারবেন।
হয়তোবা কিছু কাজের জন্য আইডি কার্ড বাধ্যতামূলক। তবে অনেক কাজ আছে, যেই কাজগুলো পাসপোর্ট দিয়েও করা যায়। যেমন-
▷ পাসপোর্ট দিয়ে বিদেশে ভ্রমণ করা যায়।
▷ পাসপোর্ট দিয়ে ভিসা চেক করা যায়।
▷ পাসপোর্ট দিয়ে ইন্টারন্যাশানাল মাস্টারকার্ড বা ক্রেডিড কার্ড করা যায়।
▷ পাসপোর্ট দিয়ে ড্রাইভিং লাইসেন্স করা যায়।
▷ পাসপোর্ট দিয়ে করোনা টিকা নিবন্ধন করা যায়।
▷ পাসপোর্ট দিয়ে টিকা সনদ সংগ্রহ করা যায়।
▷ পাসপোর্ট দিয়ে বিকাশ একাউন্ট খোলা যায়।
▷ পাসপোর্ট দিয়ে সিম ক্রয় করা যায়।
▷ পাসপোর্ট দিয়ে জন্ম নিবন্ধন চেক করা যায়।
▷ পাসপোর্ট দিয়ে টিন সার্টিফিকেট পাওয়া যায়।
এগুলো ছাড়াও একটি পাসপোর্ট দিয়ে আরও বিভিন্ন ধরণের গুরুত্বপূর্ণ কাজ সম্পাদন করা যায়।
গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথাঃ
প্রিয় পাঠক, আপনি যদি পাসপোর্ট করতে চান, তবে অবশ্যই ই-পাসপোর্ট করার চেষ্টা করবেন। এম আর পি পাসপোর্ট ও ই পাসপোর্ট কিভাবে কাজ করে তা নিশ্চই এই আর্টিকেল পড়ে বুঝতে পেরেছেন।
পাসপোর্ট করার ক্ষেত্রে অবশ্যই দালালকে এড়িয়ে চলবেন। স্বশরীরে নিজে পাসপোর্ট অফিসে কথা বলবেন। পাসপোর্টে দেওয়া তথ্য নির্ভুল রাখবেন।
যাইহোক, আশা করছি আপনারা পাসপোর্ট (passport) সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পেরেছেন। এই বিষয়ে যদি আপনাদের কোনো প্রশ্ন থাকে তবে অবশ্যই কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।