মহাকাশ নিয়ে গবেষণা বিজ্ঞানের এক নতুন দ্বার খুলে দিয়েছে। বিগ ব্যাং তত্ত্বের অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আধুনিক বিজ্ঞান এক এক করে পৃথিবীবাসীর সামনে নিয়ে আসছে। এরই মধ্যে জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ বিজ্ঞানের এক নতুন মাইলফলক।
আজ থেকে প্রায় চার শ’ বছর আগে বেসিক টেলিস্কোপ তৈরি করা হয়েছিল। এরই ধারাবাহিকতায় পর্যায়ক্রমে আধুনিক প্রযুক্তিতে তৈরি হয়েছে আরও জটিল ও উন্নত মানের বিভিন্ন টেলিস্কোপ।
জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ তারই মধ্যে একটি। তবে এই টেলিস্কোপটি পৃথিবীর অন্য সকল টেলিস্কোপের মতো নয়। এর গঠনে যেমন ভিন্নতা রয়েছে, ঠিক কার্যকারীতায়ও অন্যান্য সকল স্পেস টেলিস্কোপের চেয়ে অনেক বেশী।
এই টেলিস্কোপটি তৈরি করতে ২০ বছর সময় লেগেছে এবং ১৪ টি দেশের ২৫৮টি কোম্পানির ১০ হাজার বিজ্ঞানী এবং টেকনিশিয়ানের বিশেষ সাহায্য লেগেছে।
জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ কি?
জেমস ওয়েব মহাকাশ দূরবীক্ষণ যন্ত্র, যা জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ (James Webb Space Telescope) নামেও খ্যাত।
এটি সর্বাধুনিক প্রযুক্তিতে তৈরি একটি স্পেস টেলিস্কোপ, যা মহাকাশ গবেষণার কাজে ব্যবহার করা হয়।
এই টেলিস্কোপটি নির্মিত হয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা (NASA), কানাডিয়ান স্পেস এজেন্সি (CSA) এবং ইউরোপীয় মহাকাশ সংস্থার যৌথ উদ্যোগে।
১৯৯০ সালের প্রথম শক্তিশালী হাবল টেলিস্কোপ ছিল বিজ্ঞানীদের প্রথম স্বপ্ন। এই স্বপ্নের পথ ধরেই জেমস ওয়েবের জন্ম।
এটিকে নাসার ধ্বজাধারী নভোপদার্থবৈজ্ঞানিক মহাকাশ অভিযানের জন্য হাবল মহাকাশ দূরবীক্ষণ যন্ত্রটির উত্তরসূরী হিসেবে নির্মাণ করেছে।
জেমস ওয়েব টেলিস্কোপের গুরুত্ব ও গঠনপ্রণালী
জেমস ওয়েব নামের টেলিস্কোপটির গুরুত্ব বুঝতে হলে হাবল টেলিস্কোপের অবদান সম্পর্কে জানতে হবে।
প্রযুক্তির কল্যাণে হাবলের মাধ্যমে আমরা মহাকাশের বিভিন্ন তথ্য জানতে পেরেছি। মহাকাশ গবেষণায় হাবল যুগন্তকারী আবিস্কার করতে সক্ষম হয়েছে।
হাবল ভূপৃষ্ঠ থেকে ৫০০ কিলোমিটার উপরের মহাকাশে বিরাজ করছে।
তবে নতুন টেলিস্কোপটি পৃথিবীর অন্ধাকার অংশ থেকে প্রায় ১৫ লক্ষ কিলোমিটার দূরের মহাকাশে চূড়ান্ত অবস্থান করছে।
হাবলের তুলনায় এটি অনেক বেশী শক্তিশালী। বিজ্ঞানীরা বলছে এই টেলিস্কোপটি পৃথিবীর পাশাপাশি সূর্যকেও প্রদক্ষিণ করবে।
জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ ধারণকারী স্যাটেলাইটের নিচের অংশ সবসময় সূর্যের দিকে মুখ করে থাকবে।
স্যাটেলাইটটিতে প্রায় টেনিস কোর্টের মাপের বড় এক ছাতা রয়েছে, যা টেলিস্কোপের যন্ত্রগুলোকে আলোর বিগ্ন থেকে রক্ষা করে।
জেমস ওয়েবে রয়েছে একটি সাড়ে ৬ মিটার আয়না। যা হাবল টেলিস্কোপের তুলনায় অনেক বড়।
সোনায় মোড়ানো সে আয়নায় ৬৮টি অংশ রয়েছে, যা খুব ভালো করে ইনফ্রারেড রশ্মির প্রতিফলন ঘটাবে।
আয়নাটি বেরিলিয়াম দিয়ে তৈরি। হালকা ধাতু তীব্র শীতেও যা বেঁকে যাবে না। আয়নার উপরের অংশটি মাত্র ৫০ গ্রাম সোনা দিয়ে মোড়ানো হয়েছে।
প্রত্যেকটি অংশের পেছনে কন্ট্রোল ইউনিট রয়েছে, যার মাধ্যমে প্রয়োজন অনুযায়ী এগুলোর দিক নির্ণয় করা য়ায়।
জেমস ওয়েবের মাধ্যমে সুস্পষ্ট ছবি পেতে প্রত্যেকটা সেগমেন্টকে একসাথে নিখুঁত অবস্থায় আনতে হয়। তাহলে এটি চমৎকার ভাবে কাজ করে।
মূল বড় আয়নাটি আলো ধারণ করে একটি ছোট্ট আয়নার দিকে প্রতিফলিত করে। সেই আয়নাটি আবার সব আলো একসাথে ধারণ করে অন্য আরো দুটি আয়নার মাধ্যমে পরিমাপ যন্ত্রের দিকে পাঠিয়ে দেয়।
এভাবেই মূলত জেমস ওয়েব টেলিস্কোপটি মহাকাশের ছবি ধারণ করে।
বিজ্ঞানীদের মতে ১৩.৮ বিলিয়ন বছর আগে বিগ ব্যাং তত্ত্ব, অর্থাৎ মহা বিস্ফোরণ হয়েছিল।
হাবল টেলিস্কোপের মাধ্যমে ১৩.৪ বিলিয়ন বছর আগের আলো দেখা সম্ভব ছিল।
কিন্তু বর্তমানে জেমস ওয়েব টেলিস্কোপের মাধ্যমে ১৩.৭ বিলিয়ন বছর আগের আলো দেখাও সম্ভব হয়েছে।
তারমানে জেমস ওয়েব এতটাই শক্তিশালী টেলিস্কোপ, যার মাধ্যমে ইউনিভার্স শুরুর ১০০ মিলিয়ন বছর পরে যে তারাটির প্রথম জন্ম হয়েছিল, তাও বিজ্ঞানীদের পক্ষে জানা সম্ভব হবে।
জেমস ওয়েব উৎক্ষেপণ ও সফলতা
জেমস ওয়েব তৈরির কাজ শুরু হয়েছিল ১৯৯৬ সালে এবং এর কাজ শেষ হয়েছিল ২০১৬ সালে।
টেলিস্কোপটি তৈরির শুরুতে যদিও বাজেট ছিল ৫০০ মিলিয়ন ডলার, তবে শেষ পর্যন্ত এর খরচ গিয়ে দাঁড়িয়েছে ১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
টেলিস্কোপটি ২০১৬ সালের আগেই উৎক্ষেপণ করার কথা ছিল। তবে বিভিন্ন কারণে সেই তারিখ অনেক পিছিয়ে যায়। আর এতেই টেলিস্কোপটির বাড়তি খরচ ২০ গুণ পর্যন্ত বেড়ে যায়।
অতিরিক্ত ব্যয়ের কারণে এক পর্যায়ে আমেরিকান কর্তৃপক্ষ এই প্রকল্প বন্ধ করে দেওয়ারও হুমকি দিয়েছিল। তবে শেষ পর্যন্ত তা আর ঘটেনি।
অবশেষে পূর্বনির্ধারিত সময়সূচি অনুযায়ী নাসা জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ উৎক্ষেপণ করে ২০২১ সালের ২৫শে ডিসেম্বর মাসে।
যা ২০২২ সালে এসে নতুন এক যুগন্তকারী ইতিহাসের জন্ম দেয়।
Add comment