
দেশের নাগরিক সুযোগ -সুবিধা পাওয়ার জন্য জন্ম সনদ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আপনার যদি এখন পর্যন্ত জন্ম সনদ না থাকে, তবে জন্ম নিবন্ধন অনলাইন আবেদন করতে পারবেন। অথবা আপনার যদি ইতোমধ্যেই জন্ম সনদ থাকে তবে অনলাইনে জন্ম নিবন্ধন যাচাই করতে পারবেন।
ডিজিটাল বাংলাদেশে প্রযুক্তির অগ্রগতিতে এখন দেশের যে কোন নাগরিক নিজ ঘরে বসেই ইন্টারনেটের মাধ্যমে নতুন জন্ম নিবন্ধন আবেদন অথবা জন্ম সনদ যাচাই করতে পারে।
এই আর্টিকেলটি Jonmo Nibondhon এর উপর স্পেশাল ভাবে তৈরি করা হয়েছে। আপনি যদি আর্টিকেলটি পুরোটা পড়েন তবে জন্ম নিবন্ধন নিয়ে যত প্রশ্ন রয়েছে, প্রায় সকল প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবেন ইনশাআল্লাহ।
জন্ম নিবন্ধন কি?
জন্ম নিবন্ধন হলো বাংলাদেশের নাগরিকদের জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন বিষয়ক একটি রাস্ট্রীয় আইন, যা ২০০৪ সালের ২৯ নং আইনের আওতায় একজন মানুষের নাম, লিঙ্গ, জন্ম তারিখ, এলাকা বা স্থান, মা-বাবার নাম এবং তাদের জাতীয়তা, তাদের স্থায়ী ঠিকানা সম্মিলিত একটি রাস্ট্রীয় জন্ম সনদ।
এই সনদটি দেশের প্রত্যেক নাগরিকের জন্য খুবই প্রয়োজনীয় একটি বিষয়। এটি না থাকলে জীবন চলার পথে বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় এবং বিভিন্ন নাগরিক সেবা থেকেও বঞ্চিত হতে হয়।
জন্ম নিবন্ধনের প্রয়োজনীয়তা
দেশের বিভিন্ন নাগরিক সেবা পেতে জন্ম সনদ এর জুড়ি নেই। আপনার যদি জন্ম নিবন্ধন সনদ থাকে তবে প্রায় সব ধরণের নাগরিক সেবা পাওয়া আপনার জন্য অনেক সহজ হয়ে যাবে।
একটি জন্ম সনদ যেই কাজগুলোতে বিশেষ ভাবে প্রয়োজন হয়ঃ
- জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরিতে
- শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে
- ভোটার তালিকা প্রণয়নে
- বিবাহ নিবন্ধনে
- জমি রেজিষ্ট্রেশনে
- পাসপোর্ট তৈরিতে
- ড্রাইভিং লাইসেন্স তৈরিতে
- ঠিকাদারী লাইসেন্স তৈরিতে
- গাড়ি রেজিষ্ট্রেশনে
- ব্যবসার ট্রেড লাইসেন্স তৈরিতে
- সরকারি -বেসরকারী সংস্থায় চাকরির আবেদন পত্র ইত্যাদিতে জন্ম নিবন্ধন প্রয়োজন হয়।
উপরোল্লিখিত বিষয়গুলো ছাড়াও একটি জন্ম সনদ বিভিন্ন কাজে প্রয়োজন হয়। তাই প্রত্যেক নাগরিকের উচিত নিজ দায়িত্বে জন্ম নিবন্ধনের জন্য আবেদন করা।
জন্ম নিবন্ধন করতে কি কি লাগে?
জন্ম নিবন্ধন অনলাইন আবেদন অথবা অফলাইন আবেদন, আপনি যেভাবেই করতে যাননা কেন, নতুন জন্ম নিবন্ধন করার জন্যে একটি নির্দিষ্ট নিয়ম রয়েছে।
তাছাড়া, এটি করার জন্যে বেশ কিছু কাগজপত্রের প্রয়োজন হয়। জন্ম নিবন্ধন করতে কি কি কাগজপত্র প্রয়োজন হয়, তা নিচে তুলে ধরা হলো।
নবজাতক শিশুর জন্ম নিবন্ধন করার নিয়মঃ
- শিশুর এক কপি পাসপোর্ট সাইটের ছবি,
- শিশু যদি কোনো ক্লিনিকে বা হাসপাতালে জন্ম হয় তবে যেই প্রতিষ্ঠানের সার্টিফিকেট বা ছাড়পত্র।
- পিতা-মাতার জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি।
৫ বছরের বেশী বয়সের বাচ্চাদের জন্ম নিবন্ধন করার নিয়মঃ
- শিশুর পিতা-মাতার জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি।
- শিশুর জন্মস্থান বা স্থায়ী বসবাসের ঠিকানা প্রমাণের জন্য সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ড কাউন্সিলরের প্রত্যায়ন।
- শিশু যদি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করে তবে উক্ত প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ বা প্রধান শিক্ষকের প্রত্যায়ন।
এই তথ্যগুলোর ভিত্তিকে দেশের যে কোনো মানুষের জন্য অনলাইনে জন্ম নিবন্ধন আবেদন অথবা স্বশরীরে আবেদন করতে পারবেন।
জন্ম নিবন্ধন অনলাইন আবেদন
অনলাইনের মাধ্যমে নতুন জন্ম নিবন্ধন আবেদন করার জন্য উপরে উল্লেখিত তথ্য গুলো রেডি করুন। তারপর আপনাকে https://bdris.gov.bd/ এই ওয়েবসাইটের প্রবেশ করতে হবে।
উল্লেখ্য, অনলাইনে জন্ম নিবন্ধন করার জন্য কম্পিউটার, ল্যাপটপ অথবা যে কোনো ধরণের স্মার্টফোন ডিভাইস আপনার থাকতে হবে এবং আপনার সেই কাঙ্খিত ডিভাইসটিতে ইন্টারনেট সংযোগের প্রয়োজন হবে।
টিউটোরিয়াল আকারে পরবর্তী স্টেপ গুলো নিচে তুলে ধরা হলো। মনোযোগ সহকারে স্টেপগুলো ফলো করুন।
স্টেপ -০১
ওয়েবসাইটটিতে প্রবেশ করার পর উপরের ছবির মতো একটি পেজ ওপেন হবে। হেডলাইনে লেখা আছে “নতুন জন্ম নিবন্ধনের জন্য আবেদন।” নিচের বক্সে কিছু নীতিমালা লেখা আছে। যা আপনি চাইলে পড়ে নিতে পারেন।
তারপর প্রশ্ন করা হচ্ছে ‘জন্ম নিবন্ধন সনদ আপনার কোন ঠিকানার অফিস থেকে সংগ্রহ করতে চান? এখানে আপনার সুবিধা অনুযায়ী সিলেক্ট করবেন। আমি জন্মস্থান সিলেক্ট করে দিলাম।
প্রথম ধাপ শেষ। তারপর “পরবর্তী” বাটনে ক্লিক করুন।
স্টেপ -০২
দ্বিতীয় ধাপে আপনার সামনে উপরের ছবির মতো একটি ফরম পেজ ওপেন হবে। ফরমটির খালিঘরগুলো যথাপোযুক্ত তথ্য দিয়ে পূরণ করতে হবে।
ফরমের সবগুলো খালিঘর পূরণ করতেই হবে, তা বাধ্যতামূলক না। তবে যেগুলোতে * (স্টার) চিহ্ন দেওয়া রয়েছে সেগুলো অবশ্যই পূরণ করতে হবে। তাছাড়া আপনি চাইলে সবগুলো ঘরই তথ্য দিয়ে পূরণ করে নিতে পারেন।
বাংলা লেখাগুলো অবশ্যই ইউনিকোড ফন্টে লিখতে হবে। আর ইংরেজি লেখাগুলো সাধারণ নিয়মেই লিখতে হবে।
উল্লেখ্য, ‘বাসা ও সড়ক ( নাম, নম্বর)’ এটা যদি আপনি না জানেন তবে খালি ঘরে হাইফেন (-) দিয়ে দেবেন।
ফরমটি পূরণ করার পর “পরবর্তী” বাটনে ক্লিক করুন।
স্টেপ -০৩

তৃতীয় ধাপে আপনার সামনে উপরের ছবির মতো একটি পপআপ পেজ ওপেন হবে। এখানে ’অ্যাটাচমেন্ট অ্যাভেইলেবিলিটি চেক’ করা হবে। অর্থাৎ, জন্ম নিবন্ধন করার জন্য যেই প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টগুলো লাগবে তা উল্লেখ করে আপনাকে প্রশ্ন করা হচ্ছে।
জন্ম নিবন্ধন অনলাইন আবেদন করার জন্য উল্লেখিত ডকুমেন্টগুলো আপনার কাছে থাকতে হবে। যদি ডকুমেন্টগুলো থাকে তবে “আমার কাছে এই ডকুমেন্টগুলি আছে” এই বাটনে ক্লিক করুন।
স্টেপ -০৪
চতুর্থ ধাপে উপরের ছবির মতো আরেকটি ফরম পেজ ওপেন হবে। এখানেও যথাপোযুক্ত তথ্য দিয়ে খালিঘর পূরণ করে নিতে হবে।
উল্লেখ্য, আপনার বয়স যদি ১৮ বছরের উপরে হয় এবং আপনার যদি ন্যাশানাল আইডি কার্ড / জাতীয় পরিচয়পত্র থেকে থাকে তবে ‘জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর’ এই ঘরটি পূরণ করে নেবেন।
আর যদি আপনার জাতীয় পরিচয়পত্র না থাকে তবে ঘরটি অবশ্যই ফাকা রাখবেন। এই ফরমেও * (স্টার) যুক্ত খালিঘর গুলো পূরণ করা বাধ্যতামূলক।
ফরমটি তথ্য দিয়ে পূরণ হয়ে গেলে “পরবর্তী” বাটনে ক্লিক করুন।
স্টেপ -০৫

পঞ্চম ধাপে উপরের ছবির মতো আবারও একটি ফরম পেজ ওপেন হবে। এখানে মূলত আপনার জন্মস্থানের ঠিকানা, স্থায়ী ঠিকানা এবং বর্তমান ঠিকানা কনফর্ম করতে হবে।
আপনার জন্মস্থানের ঠিকানা, স্থায়ী ঠিকানা এবং বর্তমান ঠিকানা যদি আলাদা আলাদা হয়, তবে খালিঘরগুলোতে সঠিক ঠিকানাটি নতুন করে লিখে দিন। আর যদি জন্মস্থানের ঠিকানা, স্থায়ী ঠিকানা এবং বর্তমান ঠিকানা এক হয়, তবে “আপনার জন্মস্থানের ঠিকানা এবং স্থায়ী ঠিকানা” বাটনে টিকচিহ্ন দিন।
উল্লেখ্য, এই পেজের খালিঘরগুলো হাইড অবস্থায় থাকে। খালিঘরগুলিকে আনহাইড করার জন্য “কোনটিই নয়” এই বাটনে ক্লিক দিতে হবে।
খালিঘরগুলো পূরণ হয়ে গেলে “ পরবর্তী” বাটনে ক্লিক করুন।
স্টেপ -০৬

যষ্ঠ ধাপে উপরের ছবির মতো একটি পেজ ওপেন হবে। এখানে মূলত আবেদনকারী কে তা নিশ্চিত করতে হবে। আপনি নিজেই যদি আপনার জন্ম নিবন্ধনের জন্য আবেদন করে থাকেন তবে “নিজ” বাটনে ক্লিক দিয়ে আপনার মোবাইল নম্বর দিন। (ছবিতে তীরচিহ্ন দিয়ে দেখানো আছে।)
আর যদি আপনি জন্ম নিবন্ধন করার নিয়ম না জানেন, অন্য কারো মাধ্যমে আপনার জন্য জন্ম নিবন্ধন অনলাইন আবেদন করেন তবে আবেদনকারীর জন্ম সনদ, জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর, নাম ও মোবাইল নাম্বার এই ফরমে উল্লেখ করে দিতে হবে।
তারপর ’পরবর্তী’ বাটনে ক্লিক করুন।
স্টেপ -০৭

সপ্তম ধাপে উপরের ছবির মতো নতুন একটি পেজ ওপেন হবে। এই পেজে মূলত আপনার দেওয়া সকল তথ্য গুলো শো হবে। মনোযোগ সহকারে এই পেজটি কয়েকবার পড়ুন।
যদি কোনো তথ্য ভূল দেওয়া হয়ে থাকে তবে “পূর্ববর্তী” বাটনে ক্লিক দিন। তাহলেই আপনাকে আগের পেজে নিয়ে যাবে।
তথ্যের ভূলগুলো সংশোধন করার পর পুণরায় ‘পরবর্তী’ বাটনে চাপ দিলে আবারও এই পেজে নিয়ে আসবে।
আপনার দেওয়া তথ্যে যদি কোনো ভূল না থাকে তবে “পরবর্তী” বাটনে ক্লিক করুন।
স্টেপ -০৮

অষ্টম ধাপে আপনার আবেদনপত্রটি সফল ভাবে কর্তৃপক্ষের কাছে সাবমিট হয়ে যাবে। পাশাপাশি আপনার সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদে আবেদন পত্রটি দাখিল করা হবে।
এখানে আবেদন পত্রের একটি নম্বর দেওয়া হয়েছে। আপনাকেও এমন একটি নম্বর দেওয়া হবে। নম্বরটি যত্ন করে খাতায় লিখে নিন।
এই নম্বর দিয়ে আপনি অনলাইনে জন্ম নিবন্ধন যাচাই করতে পারবেন। জন্ম সনদের মূল কপি পাওয়ার জন্যও এটি পরবর্তীতে অবশ্যই কাজে লাগবে।
এখানে একটি বাটন দেখতে পাচ্ছেন, যেখানে লেখা আছে “আবেদন পত্র প্রিন্ট করুন”। আপনার কম্পিউটারে যদি প্রিন্টার যুক্ত থাকে তবে আবেদন পত্রটি প্রিন্ট করে নিন। অথবা প্রিন্টের দোকান থেকেও প্রিন্ট করে নিতে পারেন।
- পড়ুনঃ জমির মৌজা বের করার নিয়ম।
আপনার জন্ম নিবন্ধনটি হাতে পাওয়ার জন্য আবেদন করার ১৫ দিনের ভেতর সংশ্লিষ্ট ইউনিয়র পরিষদে প্রিন্ট করা কাগজটি অথবা আবেদন পত্রের নম্বরটি নিয়ে যাবেন।
তারপর ইউনিয়ন পরিষদের সচিব -এর কাছে আপনার কাঙ্খিত কাগজ অথবা নম্বরটি জমা দেবেন। তারা নির্দিষ্ট একটি ফি জমা নেবে এবং ইউনিয়নের সচিব ও চেয়ারম্যান কর্তৃক সত্যায়িত একটি জন্ম সনদ আপনাকে প্রদান করা হবে।
জন্ম নিবন্ধন ফি কত টাকা?
২০২২ সালের সর্বশেষ নীতিমালা অনুসারে নতুন জন্ম নিবন্ধন ফি ৩ টি ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। নিচে জন্ম নিবন্ধন ফি এর তালিকা দেওয়া হলোঃ
(১) নবজাতক শিশুর জন্মের পর থেকে ৪৫ দিন পর্যন্ত সম্পূর্ণ বিনামূল্যে নতুন জন্ম নিবন্ধনের জন্য আবেদন ও জন্ম সনদ গ্রহণ করতে পারবে। তাছাড়া, নতুন জন্ম নিবন্ধন অনলাইন করার মাধ্যমে ডিজিটাল জন্ম নিবন্ধন সনদ ডাউনলোড করতেও পারবে।
(২) শিশুর বয়স যদি ৪৫ দিনের বেশী হয় এবং ৫ বছরের কম হয় তবে তার জন্ম নিবন্ধন ফিস ২৫ টাকা।
(৩) যাদের বয়স ৫ বছরের বেশী, তাদের জন্ম নিবন্ধন ফি ৫০ টাকা।
আপনি যখন জন্ম নিবন্ধন করবেন ঠিক তখন জন্ম নিবন্ধন ফি কত টাকা হবে তা সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদ থেকে জেনে নিয়েন।
গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথাঃ
প্রিয় পাঠক, জন্ম নিবন্ধন (birth certificate) সনদ দেশের প্রত্যেক নাগরিকের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। এই সনদের মাধ্যমে নাগরিকেরা জাতীয় পরিচয়পত্র, শিক্ষা, পাসপোর্ট, লাইসেন্স জাতীয় সেবা সহ সরকারি -বেসরকারী সংস্থায় চাকরির আবেদন করতে পারে।
এজন্য প্রত্যেক নাগরিকের উচিত নিজ দায়িত্বে জন্ম নিবন্ধন করা। আপনি যদি পুরো আর্টিকেলটি মনোযোগ দিয়ে পড়ে থাকেন, তবে আশকরি জন্ম নিবন্ধন অনলাইন আবেদন করার পাশাপাশি জন্ম নিবন্ধন করার নিয়মও জেনে গেছেন।
উল্লেখিত পদ্ধতি অনুসরণ করার মাধমে যে কোনো মানুষের জন্য নতুন জন্ম নিবন্ধনের আবেদন করতে পারবেন। অনলাইনে আবেদন করার চমৎকার একটি সুবিধা হলো হাতে-কলমে আলাদাভাবে জন্ম নিবন্ধন আবেদন ফরম পূরণ করতে হয় না।
যাইহোক, অনলাইন জন্ম নিবন্ধন নিয়ে আপনার যদি আরও কোনো প্রশ্ন থাকে তবে কমেন্টে জানাতে ভুলবেন না। আমি যথাসাধ্য সহযোগীতা করার চেষ্টা করবো ইনশাআল্লাহ।