
প্রযুক্তির এক যুগন্তকারী আবিস্কারের নাম স্যাটেলাইট। মহাকাশে ঘুরে বেড়ানো এই কৃত্রিম উপগ্রহটি মানুষের জ্ঞান- বিজ্ঞানে অনেক বড় সফলতা এনে দিয়েছে। কিন্তু স্যাটেলাইট কি, স্যাটেলাইটের কাজ কি এই বিষয়ে আমাদের মনে বিভিন্ন প্রশ্নের উদ্ভব হয় প্রতিনিয়তই।
বিশাল অংকের অর্থ খরচ করে একটি স্যাটেলাইট মহাকাশে উৎক্ষেপণ করা হয়। ‘স্যাটেলাইটের সুবিধা কি কি’ যার জন্য মানুষ এত এত অর্থ খরচ করে? অপটিক্যাল ফাইবার থাকতে স্যাটেলাইটের প্রয়োজনইবা কি?
এমন সব কৌতুহলের সমাধান দিতেই এই আর্টিকেলটি তৈরি করা হয়েছে। আজ আমি আপনাকে satellite বিষয়ক সকল প্রশ্নের উত্তর দেবো। আর্টিকেলটি পড়ার মাধ্যমে জানতে পারবেন স্যাটেলাইট কাকে বলে, এটি কত প্রকার এবং কিভাবে কাজ করে।
চলুন জেনে নিই স্যাটেলাইট (satellite) এর আদ্যোপান্ত।
স্যাটেলাইট কি?
Satellite শব্দের অর্থ কৃত্রিম উপগ্রহ। অর্থাৎ, যেই উপগ্রহ গুলো পৃথিবীকে কেন্দ্র করে ঘুরে।
মহাকাশে দুই ধরণের উপগ্রহ রয়েছে। যথা- প্রাকৃতিক উপগ্রহ এবং কৃত্রিম উপগ্রহ। প্রাকৃতিক উপগ্রহ গুলো স্রষ্টা সৃষ্টি করেছেন। আর কৃত্রিম উপগ্রহ গুলো মানব কর্তৃক সৃষ্টি করা হয়েছে।
সকলেই জানি, সৌর জগতের প্রধান আটটি গ্রহ রয়েছে। আর এই গ্রহগুলোর বিভিন্ন প্রাকৃতিক উপগ্রহ আছে বলে বিজ্ঞানিরা চিহ্নিত করেছেন।
তারমধ্যে, পৃথিবীর রয়েছে ১ টি, মঙ্গলের ২ টি, বৃহস্পতির ৭৯ টি, শনির ৮২ টি, ইউরেনাস এর ২৭টি, আর নেপচুনের ১৪ টি উপগ্রহ আছে। কিন্তু বুধ এবং শুক্র এর কোন উপগ্রহ নেই।
স্যাটেলাইট কি কি উপাদান দিয়ে তৈরি করা হয় এই বিষয়ে জানার কৌতুহল আমাদের কম-বেশী সকলেই আছে। চলুন জেনে নিই Satellite এর গঠন প্রণালী সম্পর্কে।
স্যাটেলাইট আবিষ্কার ও উপাদান
উদ্দেশ্য ও কাজের উপর ভিত্তি করে প্রত্যেকটি Satellite নির্মাণ করা হয়। এজন্য প্রত্যেকটি স্যাটেলাইটে আলাদা আলাদা টেকনোলজিক্যাল ফিচার যুক্ত থাকে।
তবে এমন কিছু উপাদান রয়েছে যা প্রায় সব ধরণের স্যাটেলাইটে ব্যবহার করা হয়। নিচে এমনই কিছু উপাদানের কথা উল্লেখ করা হলো।
স্যাটেলাইট যে সকল উপাদান নিয়ে গঠিতঃ
- ব্যান্ড পাস ফিল্টার,
- লো-নয়েজ এমপ্লিফায়ার,
- ফ্রিকোয়েন্সি অনুবাদক,
- সোলার সেল এবং ব্যাটারি,
- high clock speed প্রসেসর,
- মাইক্রোওয়েভ শিফট অসিলেটর,
- রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি মিক্সার,
- পাওয়ার অ্যামপ্লিফায়ার,
- হাই রেজুলেশন বিশিষ্ট ক্যামেরা,
- হাই পাওয়ার ট্রান্সমিটিং অ্যান্টেনা,
- হাই পাওয়ার রিসিভ অ্যান্টেনা ইত্যাদি।
এগুলো ছাড়াও স্যাটেলাইটে আরো বিভিন্ন ফিচার যুক্ত থাকতে পারে।
স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ ও স্থাপন প্রক্রিয়া
Satellite বা কৃত্রিম উপগ্রহ গুলো সাধারণত পৃথিবী কেন্দ্রিক হয়। এটিকে রকেট বা স্পেস শাটলের কার্গো বে-এর মাধ্যমে মহাকাশে বা কক্ষপথে পাঠানো হয়।
একটি রকেটকে পৃথিবীর অভিকর্ষ বা মাধ্যাকর্ষণ শক্তি পার হতে ঘণ্টায় ২৫ হাজার ৩৯ মাইল বেগে ছুটতে হয়। কারণ, পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ শক্তি যে কোন উৎক্ষেপণ করা যন্ত্রকে সর্বদায় পৃথিবীর দিকে টানতে থাকে।
রকেট যদি গতির সামঞ্জস্যতা ঠিক রাখতে ব্যর্থ হয় তবে পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ শক্তিকে অতিক্রম করে কক্ষপথে Satellite বসানোর মিশন সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়ে পড়ে।
এজন্য যে কোন স্যাটেলাইট মিশন বা মহাকাশ কেন্দ্রিক যে কোন যান উৎক্ষেপণের প্রধান বাঁধা হিসেবে পৃথিবীর অভিকর্ষকে মনে করা হয়।
যেই রকেট এর মাধ্যমে মহাকাশে Satellite পাঠানো হয়, সেই রকেটকে ইনার্শিয়াল গাইডেন্স সিস্টেম (আইজিএস) মেকানিজম এর মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন।
রকেট যখন পৃথিবীর অভিকর্ষ পেরিয়ে নির্দিষ্ট কক্ষপথে পৌঁছে যায়, তখন সেখানে স্যাটেলাইট স্থাপন হয়। যদি স্যাটেলাইট স্থাপনের সময় স্যাটেলাইটে পৃথিবীর অভিকর্ষের কোন প্রভাব পড়ে তবে স্যাটেলাইট অভিকর্ষের টানে নিচে নেমে আসে। অর্থাৎ, ভূপৃষ্ঠে চলে আসতে পারে।
একটি স্যাটেলাইট প্রতি ২৪ ঘণ্টায় পৃথিবীর চারপাশে একবার ঘোরে।
স্যাটেলাইট কিভাবে ঘুরে? ভূ-পৃষ্ঠে পড়ে যায় না কেন?
স্যাটেলাইট গুলো নিরবচ্ছিন্নভাবে পৃথিবীর চার পাশে কিভাবে ঘুরে এনিয়ে আমাদের মনে বিভিন্ন প্রশ্নের উদ্ভব হতে পারে। চলুন এই বিষয়ে জেনে নেওয়া যাক।
পদার্থবিজ্ঞান এর পরমাণু অধ্যায়ে ইলেকট্রন নিয়ে একটি চমৎকার আলোচনা রয়েছে। যেখানে প্রশ্ন করা হয়েছে পরমাণুর কক্ষপথে ইলেকট্রন কিভাবে ঘুরে এবং এটি নিউক্লিয়ার শক্তিতে পতিত হয় না কেন?
এই প্রশ্নটি ”স্যাটেলাইট কিভাবে ঘুরে এবং ভূ-পৃষ্ঠে পড়ে যায় না কেন?” এই প্রশ্নের মতই।
পৃথিবীর অভিকর্ষ শক্তি বলে একটি কথা আছে। এটি পৃথিবীর অস্তিস্ব ধরে রেখেছে। অভিকর্ষে দুটি পৃথক বল্ রয়েছে। যথা- কেন্দ্রমুখী বল এবং কেন্দ্রবিমুখী বল।
স্যাটেলাইট যখন পৃথিবীর কেন্দ্র বরাবর চারপাশে ঘুরে তখন কেন্দ্রমুখী বল নামে একটি শক্তি কাজ করে। এই শক্তি স্যাটেলাইটকে পৃথিবীর দিকে টানে।
আর কেন্দ্রবিমুখী বল পৃথিবীকে দূরে ঠেলে রাখে এবং কক্ষপথ থেকে ছিটকে দিতে চায়। কিন্তু পদার্থবিজ্ঞানের গবেষণা অনুযায়ী কেন্দ্রমুখী বল এবং কেন্দ্রবিমুখী বল সমান সমান থাকার কারণে কেউ কাউকে অতিক্রম করতে পারে না।
আর এজন্যই স্যাটেলাইট পৃথিবীর কক্ষপথে ঠিক পৃথিবীর চারপাশে ঘুরছে।
স্যাটেলাইট ভূ-পৃষ্ঠে পড়ে না কেন্দ্রবিমুখী শক্তির কারণে। আবার পৃথিবীর কক্ষপথ থেকেও ছিটকে পড়ে না কেন্দ্রমুখী শক্তির কারণে।
পৃথিবী ঠিক যেই অভিকর্ষ বলে টিকে আছে, স্যাটেলাইটও তাই।
স্যাটেলাইটের কাজ কি?
অপটিক্যাল ফাইবার বা সাবমেরিন ক্যাবল, অথবা টাওয়ার বসিয়েই তো তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির বিভিন্ন কাজ সম্পাদন করা যায়। তাহলে স্যাটেলাইট এর প্রয়োজন কী? এই প্রশ্ন আপনার মনে আসতেই পারে।
স্যাটেলাইট ও অপটিক্যাল ফাইবার এর মধ্যে বিভিন্ন পার্থক্য রয়েছে।
অপটিক্যাল ফাইবার মূলত সাবমেরিন ক্যাবল বা তার সংযোগের মাধ্যমে কাজ করে। কিন্তু স্যাটেলাইটের যোগাযোগ ব্যবস্থা তার (wire) সংযোগ ছাড়া কাজ করে।
মনে করুন, আপনি জাহাজে সমুদ্রে ভ্রমণ করছেন, অথবা সাহারা মরুভূমি বা অ্যামাজন জঙ্গলের কোথাও অবস্থান করছেন। এক্ষেত্রে আপনার যোগাযোগের একমাত্র ব্যবস্থা হলো স্যাটেলাইট।
কারণ, অপটিক্যাল ফাইবার যেহেতু ক্যাবল বা তার (wire) বিশিষ্ট একটি যোগাযোগ ব্যবস্থা, তাই এর ব্যবহার গভীর সমুদ্রে, সাহারা মরুভূমি বা অ্যামাজন জঙ্গলের মতো নির্জন জায়গায় সম্পূর্ণ দুর্লভ একটি বিষয়।
আবার অন্যদিকে স্যাটেলাইট যেহেতু মহাকাশে রয়েছে এবং এটি তার ছাড়াই কাজ করে, সেহেতু পৃথিবীর যে কোন স্থান থেকেই এর ব্যবহার করা যায়।
স্যাটেলাইটের সুবিধা কি কি?
স্যাটেলাইট অগণিত সুবিধা রয়েছে। কিছু সুবিধার কথা ইতোমধ্যেই বলেছি। আরো কিছু সুবিধা নিচে তুলে ধরা হলো।
আমরা কম-বেশী সকলেই Google Maps ব্যবহার করি। গুগল ম্যাপে রাস্তা নির্ণয় করা, নিজেদের অবস্থান বা বাড়ির লোকেশন নির্ণয় করা ইত্যাদির সমস্ত বিষয় স্যাটেলাইটের জন্য সম্ভব হয়েছে।
গুগল ম্যাপ মূলত google satellite এর মাধ্যমে কাজ করে। যেটাকে satellite map ও বলা হয়ে থাকে। আপনি যদি google maps satellite view তে দেখেন তবে অনেকটা আন্দাজ করতে পারবেন।
তাছাড়া, স্যাটেলাইট এমন একটি মানবসৃষ্ট কৃত্রিম উপগ্রহ, যা দূরবর্তী টেলিযোগাযোগ, ইন্টারনেট, টিভি চ্যানেল সম্প্রচার, নিউক্লিয়ার মনিটরিং, রাডার ইমেজিং, ফটোগ্রাফি ও শত্রুর গতিবিধ পর্যবেক্ষণ, উদ্ভিদ ও প্রাণী গবেষণা, বণ্যপ্রাণীর চরে বেড়ানো পর্যক্ষেণ ইত্যাদির কাজে ব্যবহার করা হয়।
এজন্যই মূলত স্যাটেলাইটের পেছনে উন্নত দেশগুলো বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ব্যয় করে থাকে।
আপনি হয়ত ইতোমধ্যেই জানেন, ২০১৮ সালের ১১ মে বাংলাদেশের স্যাটেলাইট -বঙ্গবন্ধু-১ মহাকাশে উৎক্ষেপণ করা হয়েছে এবং আমরা বিভিন্ন ভাবে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট এর সুবিধা উপভোগ করছি।
পৃথিবী থেকে স্যাটেলাইটের দূরত্ব কত?
স্যাটেলাইট মূলত কক্ষপথে অবস্থান করে। একটি স্যাটেলাইট ২৪ ঘন্টায় পৃথিবীর চারদিকে একবার ঘোরে। প্রসঙ্গক্রমে অনেকেই প্রশ্ন করে থাকেন পৃথিবী থেকে কত কিলোমিটার উপরে স্যাটেলাইট স্থাপন করা হয়?
সাধারণত ৮০-১ হাজার ২০০ মাইল উচ্চতাবিশিষ্ট কক্ষপথে বিভিন্ন ধরনের স্যাটেলাইট স্থাপন করা হয়। তবে কাজের ধরনের ওপর নির্ভর করে কাঙ্খিত স্যাটেলাইটটি কতটুকু উচ্চতায় বসবে।
যেমন উদ্ভিদ ও প্রাণী গবেষণা, বণ্যপ্রাণী পর্যক্ষেণ, অ্যাস্ট্রোনমি এবং পদার্থ বিজ্ঞান গবেষণা করার জন্য সায়েন্স ক্যাটাগরির স্যাটেলাইটকে ৬ হাজার থেকে ৩০ হাজার মাইল উচ্চতায় স্থাপন হয়।
আবার গোবাল পজিশনিং সিস্টেম এর জন্য তৈরি (জিপিএস) স্যাটেলাইটকে ৬ হাজার থেকে ১২ হাজার মাইল উচ্চতায় স্থাপন করতে হয়।
পৃথিবী থেকে স্যাটেলাইটের দূরত্ব কত হবে তা মূলত স্যাটেলাইটের বৈশিষ্ট্য ও গঠন প্রণালীর উপর ভিত্তি করে।
গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথাঃ
প্রযুক্তির যুগন্তকারী আবিস্কার স্যাটেলাইট মানব সভ্যাতাকে একধাপ এগিয়ে নিয়ে গেছে। স্যাটেলাইটের মাধ্যমে আমরা পৃথিবীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সম্পর্কে জানতে সক্ষম হয়েছি।
শুধু পৃথিবীই নয়; স্যাটেলাইটের কল্যাণে মহাকাশের জ্ঞানেও আমরা সমৃদ্ধ হতে পেরেছি। আর এই সমৃদ্ধতা ভবিষ্যতকে আরো উজ্জ্বল করবে বলে মনে করি (ইনশাআল্লাহ)।
প্রিয় পাঠক! আমি চেষ্টা করেছি স্যাটেলাইট কি এবং এটি কিভাবে কাজ করে এই বিষয়ে আলোচনা করার জন্য। “স্যাটেলাইট বলতে কি বুঝায়” আশাকরি এই বিষয়ে সুস্পষ্ট ধারণা পেয়েছেন।
স্যাটেলাইট সম্পর্কিত যদি আপনার আরো কোন প্রশ্ন থাকে তবে কমেন্ট করতে ভুলবেন না। আমি যথাসাধ্য আপনার প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করব। আর্টিকেলটি পড়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
ভাই, স্যাটেলাইট কি পৃথিবীর ভেতরে নাকি বাহিরে? আর কিভাবে ওখানে স্থাপন করা হয়েছে একটু বলবেন